Monday, 29 September 2014

স্মৃতিটুকু থাক


গুগল-বাবুর সেই বিখ্যাত মেল-টা পাওয়ার দুদিন পরেই লেখাটা লিখেছিলাম। আমি মহান তাই এতদিন পোস্ট করিনি। কাল তো টা টা বাই বাই, তাই শেষ লগ্নে একটা বেশ ফেয়ারওয়েল জাতীয় ব্যাপার হবে ভেবে পোস্ট-টা করছি।

সেদিন 

মেল চেক করতে গিয়ে একটা মেল-এ চোখ পড়ল। একটা বেশ বড়সড় মেল, যার সোজাসাপ্টা বক্তব্যটা খানিকটা এরকম- বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ারকিং সাইটের দৌরাত্ম্যে ‘অর্কুট’ এর জনপ্রিয়তা কমেছে, তাই ৩০শে সেপ্টেম্বর বিদায় নিচ্ছে ‘অর্কুট’। মেলটা পড়তেই চমকে উঠলাম। মানেটা কী? অর্কুট আর থাকবে না? অর্কুট করি না তো কী হয়েছে? তার মানে কী অর্কুট বন্ধ হয়ে যেতে হবে? এসব ভাবতে ভাবতে গুগলকে গালমন্দ দিতে দিতে ‘ফেসবুকে’ ঢুকলাম। হ্যাঁ, ফেসবুকেই লগ ইন করলাম, অর্কুটেনয়। সবার সাথে এটা নিয়ে কথা বলাটা, আপডেট দেওয়াটা তখন মোটামুটি জাতীয় কর্তব্য মনে হল। তবে ফেসবুকে ঢুকতেই মনটা হু হু করে উঠল। অনেকেই দেখলাম অর্কুট এর অ্যালবামগুলো ফেসবুকে আপলোড করতে শুরু করেছে। গুচ্ছ গুচ্ছ আই উইল মিস ইউ জাতীয় আপডেট। ওসব দেখেটেখে মনে হল আমিও একবার ঘুরে আসি। শেষ বোধহয় সাত আট মাস আগে গেছিলাম। লগ ইন করতে গিয়ে মনে পড়ল, আমার পুরনো প্রোফাইলটা চার বছর আগে ডিলিট করে দিয়েছিলাম। এখন যেটা আছে সেটাতে আমার অর্কুট জীবনের কোন নিদর্শন নেই। এই প্রোফাইল দেখলে মনেই হবে না একটা সময়ে এই মেয়েটার জীবনের কতটা জুড়ে ছিল অর্কুট। স্ক্র্যাপবুক ফাঁকা, একটাও টেস্টিমোনিয়াল নেই, ফ্যানলিস্ট খালি- আমার প্রোফাইল টা যেন অরকুটের করুণ দশাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
ভাবতে অবাক লাগে, সাতটা বছর জীবনকে কত বদলে দিতে পারে। ২০০৭ এর মাঝামাঝি সময়ে আমার অরকুটে প্রবেশ। যতদূর মনে পড়ছে, অ্যাকাউন্ট-টা বোধহয় কোন এক বন্ধুর বাড়িতে খোলা। তার কদিনের মধ্যেই আমার বাড়িতে নেট আসে। যতদিন নেট ছিল না একরকম, নেট আসতেই সারাক্ষণ অর্কুট খুলে বসে থাকতাম। আমার প্রথম চ্যাট ফ্রেন্ডের সাথে আমার এখনও গলায় গলায়। শুরুর দিকের সেই চ্যাট ফ্রেন্ড বানানোর আগ্রহটা কিন্তু একদম অন্যরকম ছিল। কথা বলব কীনা, কতটাই বা বলা যায় একে, বেশি কথা বললে আবার অন্য কিছু ভাববে নাতো? ভুলভাল নয়তো? হাজার চিন্তা। চিন্তা মানে রীতিমত চিন্তা। আর তারপর তাদের সাথে যখন দেখা করতে যাওয়া হয়, সে আর এক টেনশন। তখনও ইন্টারনেটে ছবি দেওয়াটা এত দুধ-ভাত ছিল না। তাই কিছুটা ব্লাইন্ড ডেটের মত ব্যাপার ছিল আর কী। আর যদি সত্যি ডেট হয় তো হয়ে গেল, মানে ভালো লাগছে, এবার দেখা করলেই হয়, অথচ দেখা করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চিন্তা, কেমন দেখতে হবে। আমার দেখা অনেক প্রেমেরই জন্ম দিয়েছে অর্কুট। সব সম্পর্ক হয়ত টেকেনি, তবে অনেক অটুট সম্পর্কের ভীতও ওই অরকুট। বন্ধুত্ব কিংবা প্রেম। এবং ক্রাশ। কতজনকে যে ওই একটু আধটু ভালো লাগল তার ইয়ত্তা নেই। আর সেই ভালো লাগা-গুলো সত্যি সত্যিই অনেক রাত জাগিয়েছে... রাত ভোর হয়েছে শুধু ওদিকের স্ক্র্যাপ এর অপেক্ষায়।
তবে শুধু শুকনো বন্ধুত্বে তো হবে না, অর্কুটে মান-সম্মান রাখতে হলে ভাল ভাল টেস্টিমোনিয়াল লেখাতে হবে বন্ধুদের দিয়ে।তবে টেস্টিমোনিয়াল পাওয়ার একটাই প্রাথমিক আর ইউনিভারশাল শর্ত ছিল- ‘আমাকে একটা লিখে দে আগে।’ আর ছিল ফ্যান লিস্ট। আর একটা দারুন ফিচার ছিল অরকুটের- প্রোফাইল ভিউয়ারস। আমার প্রোফাইল কে কবে দেখেছে সব দেখা যেত অর্কুটে। যদি কখনও ভুল করে ব্যাথা আছে এমন কারুর নাম সেখানে থাকত, ব্যাস, মনে হত বিশ্বজয় করা হয়ে গেছে।
তবে আমার জীবন বদলে দেয় অর্কুট কমিউনিটি। ক্রিকেট কমিউনিটিগুলোতে আমি ছিলাম বেশ জনপ্রিয়। সৌরভ-রাহুল নিয়ে রোজই দক্ষযজ্ঞ চলত সেই সময়ে। বড্ড টালমাটাল সময় ছিল কিনা। সৌরভ ফ্যানরা গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে রাহুল দ্রাবিড়ের মুন্ডপাত করত আর প্রতিবাদে রাহুল অনুরাগীরা তেড়ে আসত। আমার একূল ওকূল দুদিকই ভাসত মোটামুটি। রাহুল দ্রাবিড়ের অন্ধ ভক্ত, আবার দাদাকেও ছাড়তে পারতাম না। তার ওপর মোডারেটর হওয়ার আর এক ঝামেলা। কত গালমন্দ জুটেছে। দ্রাবিড়ের হয়ে বললে দাদা আর্মি ক্ষেপে গেছে, আবার দাদার হয়ে গলা ফাটালে শুনেছি আমি নাকি লয়্যাল ফ্যান নই। বোঝো ঠ্যালা।
আগে শুধু ম্যাচ দেখতাম। কিন্তু তখন টিভিতে ম্যাচ, আর সামনে অর্কুট কমিউনিটির ‘থ্রেড’। উফ, সে কি উত্তেজনা, কত আলোচনা, রাত ভোর করে কত আড্ডা। আমার ক্রিকেট প্রেমটা আরও উস্কে দিয়েছে অর্কুট। প্রেমটাও। শুধু ক্রিকেটে আর সীমাবদ্ধ থাকেনি সেই আড্ডা। অর্কুটেও আটকে থাকেনি। অর্কুট থেকে গুগল ট্যক, ইয়াহু মেসেঞ্জারে চলেছে গল্প। এখন অর্কুটের জায়গায় ফেসবুক, আর ওয়াইএম এর জায়গায় এসেছে হোয়াটসঅ্যাপ।
সেই বন্ধুরা আর এখন শুধু চ্যাট ফ্রেন্ড নেই। সম্পর্ক জমাট বেঁধেছে। বন্ধুত্ব অটুট আছে। তবে প্রেমটা নেই। মানে বিয়েটা হয়ে গেছে আর কি। হ্যাঁ আমার প্রেমের ভীতটা অরকুটের ক্রিকেট কমিউনিটি। সবটাই আছে, শুধু অর্কুট থাকবে না এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমিই তো অর্কুট থেকে ফেসবুকে চলে গেছি। এমনকি আমার প্রোফাইলটাও ডিলিট করে দিয়েছিলাম অনেক আগেই। নিজেই দূর ছাই করেছি। তবু তো ছিল। চাইলেই তবু নাগাল পেতাম। পাত্তা না দিলেও পেতাম। আর অরকুট ডট কম এর সাইট-টা খুলবে না। প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেও না। তবু অর্কুট থাকবে। থাকতে হবে। প্রথম প্রেম কী কখনও ছেড়ে চলে যায়, না যেতে পারে? তাহলে অর্কুট-ই বা কী করে যাবে? আর অর্কুট তো সেই ভালবাসার মানুষটার মতো, যাকে যতই অবহেলা করি না কেন অস্বীকার করতে পারি না কিছুতেই। আর এতদিন তো জানতাম সেও কোনদিন ছেড়ে চলে যায় না। যেতে পারে না। তাহলে?

আজ
তাহলে ৩০শে সেপ্টেম্বর এসেই গেল। তার মানে এটাই শেষ। এক একবার মনে হচ্ছে সত্যিই কী আর কোন উপায় নেই? মানে কয়েকমাস আগে যেমন একটা মেল পেয়েছিলাম সেরকম আরেকটা যদি আসে? মানে হঠাৎ যদি সিদ্ধান্ত বদল করে গুগল। মানে নিদেনপক্ষে একটা বিবেচনা জাতীয় কিছু করবে টরবে বলে মেল পাঠায়? আর তারিখটা পিছিয়ে যায়...

আর তারপর আবার পিছিয়ে যায় আর এমনি করেই যদি তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ হতে থাকে... জাস্ট যদি...

3 comments: