Thursday 23 October 2014

একটা চিঠি

লেখাটা সেই ২০১২-তে লেখা... একটা ম্যাগাজিনের জন্যে লিখেছিলাম। মনে হল পোস্ট করি। কিছু কিছু এডিট করে পোস্টটা করে ফেললাম। 


শ্রদ্ধাস্পদেষু,

নবমীর দিন সকালে একটা ফোন পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেই ফোনটাতেই জানতে পারি যে আপনি আর নেই। সত্যি বলতে কী ঘুমের রেশটা তখনো কাটেনি বলেই বোধহয় প্রথমে কিছুই মনে হয়নি। শুধু একটা খবর। খারাপ খবর। তারপরে মাকে খবরটা জানাই। মায়ের প্রথম কথাই ছিল যাঃ। নাহ্‌ তখনও আমি সেইভাবে কিছু অনুভব করিনি। টিভিটা চালালাম। যা হয়। কেউ চলে গেলে তাকে নিয়ে মাতামাতি হওয়াটা ব্যতিক্রমী কিছু নয়। কিন্তু চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে একটা খবরে চোখ আতকে গেল- ‘নবমীতে নেই নীললোহিত’। এই ‘নেই’ ব্যাপারটা শুনেই কেমন একটা খালি খালি লাগছিল। ঠিক কেন বুঝিনি। আমি তো বিশাল সাহিত্যবোদ্ধা নই যে ‘নীরা’র জন্য মন খারাপ হবে কিম্বা আপনার অন্য কবিতাগুলোর কথা মনে পড়বে। তবুও কীসের যেন একটা অভাববোধ করছিলাম। হাল্কা একটা খারাপ লাগা- কিন্তু ঠিক কী? কেন? মনখারাপটা নিয়েই নেট খুলে বসলাম। ফেসবুকে দু-একটা পোস্ট চোখে পড়ল আর চোখে পড়ল একটা ব্লগ। তপোব্রত’র লেখা। লেখাটা আপনাকে নিয়েই। আপনি কত ভাল, বাংলা সাহিত্যের কত বড় নক্ষত্র- এসব আর কী! বোঝেনই তো! পড়লাম। লেখার শেষ লাইনটা পড়েই খুব মন খারাপ হয়ে গেল।খুব! হঠাৎ মনে হল, কী বিশাল এক সম্পদ হারিয়ে ফেললাম আমি। লেখার শেষ লাইনটা ছিল, “কাকাবাবুর ক্রাচের শব্দ আর শুনতে পাব না” হ্যাঁ, নীরা নয়, নীল মানুষ নয়, গঙ্গানারায়ণ নয়- কেউ নয়। কাকাবাবু। আমি কাকাবাবুকে হারালাম। ‘কাকাবাবু’ আর নেই। এটা যেই বুঝলাম, খারাপ লাগাটা আরও বেশি করে চেপে বসল। কাকাবাবু নেই মানে যে আমার শৈশবের অনেকটাই আর নেই।

ঠিক মনে নেই কবে থেকে, যেদিন থেকে গল্পের বই পড়া শুরু তখন থেকেই কাকাবাবুর পাগল ভক্ত আমি। শুনলে হয়তো অনেকে হাসবেন, আপনিও হয়তো। ফেলুদা নয়, কাকাবাবু দিয়েই আমার গোয়েন্দা গল্প পড়া শুরু। তারপরেই একে একে ফেলুদা, শার্লক হোমস, ব্যোমকেশের আগমন। আপনি হয়তো ভাবছেন আজ আপনি নেই বলে এসব বলছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন এটাই সত্যি।

আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী তো ছিলই, আমার মনে আছে যখন ‘কাকাবাবু সমগ্র’ বেরোতে শুরু হল, মা আমাকে প্রতি জন্মদিনে একটা করে কাকাবাবু সমগ্র কিনে দিত। কী খুশিই না হতাম। ‘কাকাবাবু সমগ্র ৬’ অবশ্য এখনো পড়া হয়নি। এই অগস্টেই কিনেছি। কাকাবাবু আমার শৈশবের ঠিক কতটা জুড়ে ছিল আমি নিজেও জানি না। মনে পড়ে একটা স্বপ্নও দেখেছিলাম। আমার কিছু স্কুলের বন্ধু, আমি, কাকাবাবু আর সন্তু একটা ভাঙ্গা সিঁড়ি দিয়ে নামছি। হাতে মোমবাতি। খুব হাসি পেয়েছিল পরে। আর একবার বইমেলায় আপনাকে দেখেছিলাম। ছোটবেলায় তো, তাই খুব ভাল করে মনে নেই। স্টেজে ছিলেন আপনি। তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, আর আমি বাবা-মার সঙ্গে সেই বিকেল থেকে ঘুরছি। তখন বেরোব বেরোব করছি আর আপনাকে দেখতে পেলাম। ব্যাস, আমাকে আর পায় কে! কথা বলব, কথা বলব করে বায়না জুড়লাম। কোনও একটা অনুষ্ঠান চলছিল বলেই বাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে তখনই কথা বলা সম্ভব নয়। অপেক্ষা করা মানে আরো দেরী হওয়া। তাই আর কী, ধমক দিয়ে দমিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন, বাবার ওপর খুব রাগ হয়েছিল। এখন বড্ড বেশি মনে পড়ছে সেই সন্ধ্যেটা আর খুব কান্না পাচ্ছে। নাহ, আজ আর রাগ নেই, মানে কী লাভ? যাই হোক। সেদিন আমার প্রশ্নটা কী ছিল জানেন? ‘কাকাবাবু’ আবার কবে বেরোবে? হ্যাঁ আমার কাছে সুনীল গাঙ্গুলি মানেই কাকাবাবু। বড় হয়ে আপনার আরও অনেক লেখা পড়েছি। মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু আপ্লুত হইনি। কোন চরিত্রের ফ্যান হয়ে যাইনি। কাকাবাবুর জন্য আমি এতটাই পাগল ছিলাম।

কাকাবাবুকে কেন ভাল লাগত জানি না। আমাকে অনেকে এই প্রশ্ন করেছে। আমি উত্তর দিতে পারিনি। আমার তো কাকাবাবুকে এমনি এমনিই ভাল লাগে। ‘হিরোইজম’-এর কিছুই সেভাবে আমার কাকাবাবুর মধ্যে নেই। একটা পা অকেজো, ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন। পঞ্চাশোর্ধ বয়স এখন। বিরাট কিছু হ্যান্ডসাম, তাও নন। তবু ওনাকেই আমার ভাল লাগে। ভাবতে অবাক লাগে যে বন্দুক থাকলেও কাকাবাবু খুব একটা গুলি চালান না। পারেন না আর কী! কাউকে অত্যাচার করতে পছন্দ করেন না। তবে হ্যাঁ, কেউ ওনাকে অকারণে কষ্ট দিলে সেটা ফেরত দিতে ভোলেন না। মনে আছে ‘নীলমূর্তি রহস্য’তে ভিলেন, যিনি আবার জোজোর পিসেমশাই, তাঁর গায়ে লাল  পিঁপড়ে ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুতভাবে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। এদিকে ভাইপো সন্তুর ব্যাপারে প্রচন্ড যত্নবান, আবেগপ্রবণ। সন্তুর কোনরকম বিপদে কাকাবাবু মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। এখানেই তিনি অন্য সব গোয়েন্দার থেকে আলাদা। এজন্যেই তিনি ‘কাকাবাবু’, খুব সহজেই শুধু সন্তু নয়, সবার কাকাবাবু হয়ে উঠতে পারেন।

সন্তুর কথা যখন এসেই গেল তখন একটা সিক্রেট আজ বলেই ফেলি। আমার ছোট্টবেলার প্রথম ক্রাশ সন্তু। জোজো আবার ঠিক উল্টো, চরম ভীতু, এদিকে মনের সুখে গুল মারে। কাকাবাবু মিথ্যে ঘৃণা করলেও জোজোকে বেশ পছন্দ করেন দেখেছি। জোজোর ঐ গুলবাজি আমারও দারুণ লাগে। ট্যালেন্ট আছে ছেলের। তবে ঐ মেয়েটা- দেবলীনা দত্ত। ওকে কিন্তু আমার বেশ হিংসে হত। শেষ কয়েকটা রহস্য উপন্যাসে দেবলীনা নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। কী যে ইচ্ছে হত দেবলীনা হতে। আর ভাল লাগতো নরেন্দ্র ভার্মাকে।

জানেন, আমার বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে আপনাকে কাকাবাবু নিয়ে অনেক অনেক প্রশ্ন করব। কী প্রশ্ন জানি না, শুধু জানতাম ‘কাকাবাবু’ কে নিয়ে কথা বলব। আমার কাছে যে আপনিই কাকাবাবু! আপনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। আপনার হয়তো মনে নেই, আমার আছে। প্রতিবারই শুনেছি, “হ্যাঁ বলো, কী জানতে চাও?” অনেক কিছু জেনেছি। কোনদিন ফিরিয়ে দেননি। কিন্তু কাকাবাবুকে নিয়ে কথা তুলতেই পারিনি।সত্যি বলছি ভাবতেই পারিনি এরকম হঠাৎ করেই চলে যাবেন, একেবারে জানান না দিয়ে! আমি যে ঠিক কী হারালাম বোঝাতে পারব না। আপনি আমাকে কী দিয়ে গেছেন, আমার ছোটবেলাকে কী দিয়ে গেছেন, আমার ছোটবেলাকে কিভাবে ভরিয়ে দিয়েছেন আপনি নিজেও বোধ হয় জানেন না। আমি নিশ্চিত আমি একা নই, ‘কাকাবাবু’র এরকম অসংখ্য পাগল ভাইপো-ভাইঝি আছে। কেউ সন্তুর মতো, কেউ জোজোর মতো, কেউ দেবলীনার মতো, কেউ আবার এই শ্রেয়সীর মত।
ছোটবেলায় কতবার ভেবেছি চিঠি লিখব, হয়ে ওঠেনি। সাহসও হয়নি আসলে। মানে মনে হয়েছে যদি উত্তর না পাই। আর আজ দেখুন, উত্তর পাব না জেনেও লিখছি। লিখতে হচ্ছে। নাহলে আরও কষ্ট হবে যে। 
সেদিনই ‘গোলকধাঁধায় কাকাবাবু’টা পড়ছিলাম। এবারের আনন্দমেলায় কাকাবাবু নিয়ে বেরনো আপনার শেষ লেখা। ভাল লাগেনি। সত্যি বলছি। শুধু এটাই না, শেষ পাঁচ-ছটা কাকাবাবু আমার একদমই ভাল লাগেনি। কাকাবাবুর পাগল ভক্ত হয়েও লাগেনি। বন্ধুদের মধ্যে আলোচনাও করেছি, কেন যে সুনীল গাঙ্গুলি লিখছেন এরকম। লেখার থেকে না লেখাই ভাল তো। হ্যাঁ এরকম কত কথাই তো বলেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভাগ্যিস লিখেছিলেন। ‘কাকাবাবু’কে থামতে দেননি। ‘কাকাবাবু’ আজও অমর।
কদিন আগে একটা লেখায় চোখ পড়েছিল। ফেসবুকে একজন লিখেছে ১৯৯৮-এর পর সে আর আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী কেনেনি। কেন জানেন? ৯৮’র ‘কাকাবাবু’টা শেষ করতে পারেনি। একদম ভাল লাগেনি। ব্যাস আনন্দমেলা পড়াই শেষ! ভাবুন তাহলে কী করেছেন আপনি! এটাই কাকাবাবুর ম্যাজিক, আপনার ম্যাজিক! আমিও অবশ্য সামনের বছর থেকে আনন্দমেলা আর কিনব না। কারণটা আর নিশ্চয়ই বলতে হবে না...
আপনি আজ নেই। তবে লোকে বলে আত্মা অবিনশ্বর। আপনার মত নাস্তিক লোক আত্মা-টাত্মা মানতেন বলে মনে হয় না। আমিও মানি না খুব একটা। কিন্তু কেন জানি না, মনে হয় এখনো হয়তো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মধ্যরাতে কলকাতা দাপিয়ে বেড়ানোর প্ল্যান করছেন। আপনার জীব্বদশায় কাকাবাবু নিয়ে কথা বলা হয়নি। এটা আমার জীবনের বড় আফশোষ। তখন পারিনি, আজ বলছি, থ্যাঙ্ক ইউ। আমাকে এরকম দারুণ একটা শৈশব দেওয়ার জন্য। ‘কাকাবাবু’কে থামতে না দেওয়ার জন্য, অবিরাম লিখে যাওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
তবে ওই ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’ নামটাতে আমার বড্ড আপত্তি। এরকম একটা নাম না দিলেই পারতেন। কারণ, কাকাবাবু তো হারতে পারেন না। রাজা রায়চৌধুরী কোনদিন হারেন না।
২০১২ আমার থেকে অনেককিছু কেড়ে নিয়েছে। আমি আর কোনদিন ‘আমি’ হয়ে উঠতে পারব না। ডিটেলে নাই বা গেলাম, এটুকু বলতে পারি তার জন্যে কিছুটা আপনিও দায়ী। মানে... মানে সামনের পুজোতে সব থাকবে শুধু আমার কাকাবাবু থাকবে না। আমার পুজো বলতে তো ওইটুকুই ছিল আর, সেটাও থাকবে না...এটা কি মেনে নেওয়া যায় বলুন?
ইতি
‘কাকাবাবু’র জনৈকা ভাইঝি






Monday 29 September 2014

স্মৃতিটুকু থাক


গুগল-বাবুর সেই বিখ্যাত মেল-টা পাওয়ার দুদিন পরেই লেখাটা লিখেছিলাম। আমি মহান তাই এতদিন পোস্ট করিনি। কাল তো টা টা বাই বাই, তাই শেষ লগ্নে একটা বেশ ফেয়ারওয়েল জাতীয় ব্যাপার হবে ভেবে পোস্ট-টা করছি।

সেদিন 

মেল চেক করতে গিয়ে একটা মেল-এ চোখ পড়ল। একটা বেশ বড়সড় মেল, যার সোজাসাপ্টা বক্তব্যটা খানিকটা এরকম- বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ারকিং সাইটের দৌরাত্ম্যে ‘অর্কুট’ এর জনপ্রিয়তা কমেছে, তাই ৩০শে সেপ্টেম্বর বিদায় নিচ্ছে ‘অর্কুট’। মেলটা পড়তেই চমকে উঠলাম। মানেটা কী? অর্কুট আর থাকবে না? অর্কুট করি না তো কী হয়েছে? তার মানে কী অর্কুট বন্ধ হয়ে যেতে হবে? এসব ভাবতে ভাবতে গুগলকে গালমন্দ দিতে দিতে ‘ফেসবুকে’ ঢুকলাম। হ্যাঁ, ফেসবুকেই লগ ইন করলাম, অর্কুটেনয়। সবার সাথে এটা নিয়ে কথা বলাটা, আপডেট দেওয়াটা তখন মোটামুটি জাতীয় কর্তব্য মনে হল। তবে ফেসবুকে ঢুকতেই মনটা হু হু করে উঠল। অনেকেই দেখলাম অর্কুট এর অ্যালবামগুলো ফেসবুকে আপলোড করতে শুরু করেছে। গুচ্ছ গুচ্ছ আই উইল মিস ইউ জাতীয় আপডেট। ওসব দেখেটেখে মনে হল আমিও একবার ঘুরে আসি। শেষ বোধহয় সাত আট মাস আগে গেছিলাম। লগ ইন করতে গিয়ে মনে পড়ল, আমার পুরনো প্রোফাইলটা চার বছর আগে ডিলিট করে দিয়েছিলাম। এখন যেটা আছে সেটাতে আমার অর্কুট জীবনের কোন নিদর্শন নেই। এই প্রোফাইল দেখলে মনেই হবে না একটা সময়ে এই মেয়েটার জীবনের কতটা জুড়ে ছিল অর্কুট। স্ক্র্যাপবুক ফাঁকা, একটাও টেস্টিমোনিয়াল নেই, ফ্যানলিস্ট খালি- আমার প্রোফাইল টা যেন অরকুটের করুণ দশাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
ভাবতে অবাক লাগে, সাতটা বছর জীবনকে কত বদলে দিতে পারে। ২০০৭ এর মাঝামাঝি সময়ে আমার অরকুটে প্রবেশ। যতদূর মনে পড়ছে, অ্যাকাউন্ট-টা বোধহয় কোন এক বন্ধুর বাড়িতে খোলা। তার কদিনের মধ্যেই আমার বাড়িতে নেট আসে। যতদিন নেট ছিল না একরকম, নেট আসতেই সারাক্ষণ অর্কুট খুলে বসে থাকতাম। আমার প্রথম চ্যাট ফ্রেন্ডের সাথে আমার এখনও গলায় গলায়। শুরুর দিকের সেই চ্যাট ফ্রেন্ড বানানোর আগ্রহটা কিন্তু একদম অন্যরকম ছিল। কথা বলব কীনা, কতটাই বা বলা যায় একে, বেশি কথা বললে আবার অন্য কিছু ভাববে নাতো? ভুলভাল নয়তো? হাজার চিন্তা। চিন্তা মানে রীতিমত চিন্তা। আর তারপর তাদের সাথে যখন দেখা করতে যাওয়া হয়, সে আর এক টেনশন। তখনও ইন্টারনেটে ছবি দেওয়াটা এত দুধ-ভাত ছিল না। তাই কিছুটা ব্লাইন্ড ডেটের মত ব্যাপার ছিল আর কী। আর যদি সত্যি ডেট হয় তো হয়ে গেল, মানে ভালো লাগছে, এবার দেখা করলেই হয়, অথচ দেখা করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চিন্তা, কেমন দেখতে হবে। আমার দেখা অনেক প্রেমেরই জন্ম দিয়েছে অর্কুট। সব সম্পর্ক হয়ত টেকেনি, তবে অনেক অটুট সম্পর্কের ভীতও ওই অরকুট। বন্ধুত্ব কিংবা প্রেম। এবং ক্রাশ। কতজনকে যে ওই একটু আধটু ভালো লাগল তার ইয়ত্তা নেই। আর সেই ভালো লাগা-গুলো সত্যি সত্যিই অনেক রাত জাগিয়েছে... রাত ভোর হয়েছে শুধু ওদিকের স্ক্র্যাপ এর অপেক্ষায়।
তবে শুধু শুকনো বন্ধুত্বে তো হবে না, অর্কুটে মান-সম্মান রাখতে হলে ভাল ভাল টেস্টিমোনিয়াল লেখাতে হবে বন্ধুদের দিয়ে।তবে টেস্টিমোনিয়াল পাওয়ার একটাই প্রাথমিক আর ইউনিভারশাল শর্ত ছিল- ‘আমাকে একটা লিখে দে আগে।’ আর ছিল ফ্যান লিস্ট। আর একটা দারুন ফিচার ছিল অরকুটের- প্রোফাইল ভিউয়ারস। আমার প্রোফাইল কে কবে দেখেছে সব দেখা যেত অর্কুটে। যদি কখনও ভুল করে ব্যাথা আছে এমন কারুর নাম সেখানে থাকত, ব্যাস, মনে হত বিশ্বজয় করা হয়ে গেছে।
তবে আমার জীবন বদলে দেয় অর্কুট কমিউনিটি। ক্রিকেট কমিউনিটিগুলোতে আমি ছিলাম বেশ জনপ্রিয়। সৌরভ-রাহুল নিয়ে রোজই দক্ষযজ্ঞ চলত সেই সময়ে। বড্ড টালমাটাল সময় ছিল কিনা। সৌরভ ফ্যানরা গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে রাহুল দ্রাবিড়ের মুন্ডপাত করত আর প্রতিবাদে রাহুল অনুরাগীরা তেড়ে আসত। আমার একূল ওকূল দুদিকই ভাসত মোটামুটি। রাহুল দ্রাবিড়ের অন্ধ ভক্ত, আবার দাদাকেও ছাড়তে পারতাম না। তার ওপর মোডারেটর হওয়ার আর এক ঝামেলা। কত গালমন্দ জুটেছে। দ্রাবিড়ের হয়ে বললে দাদা আর্মি ক্ষেপে গেছে, আবার দাদার হয়ে গলা ফাটালে শুনেছি আমি নাকি লয়্যাল ফ্যান নই। বোঝো ঠ্যালা।
আগে শুধু ম্যাচ দেখতাম। কিন্তু তখন টিভিতে ম্যাচ, আর সামনে অর্কুট কমিউনিটির ‘থ্রেড’। উফ, সে কি উত্তেজনা, কত আলোচনা, রাত ভোর করে কত আড্ডা। আমার ক্রিকেট প্রেমটা আরও উস্কে দিয়েছে অর্কুট। প্রেমটাও। শুধু ক্রিকেটে আর সীমাবদ্ধ থাকেনি সেই আড্ডা। অর্কুটেও আটকে থাকেনি। অর্কুট থেকে গুগল ট্যক, ইয়াহু মেসেঞ্জারে চলেছে গল্প। এখন অর্কুটের জায়গায় ফেসবুক, আর ওয়াইএম এর জায়গায় এসেছে হোয়াটসঅ্যাপ।
সেই বন্ধুরা আর এখন শুধু চ্যাট ফ্রেন্ড নেই। সম্পর্ক জমাট বেঁধেছে। বন্ধুত্ব অটুট আছে। তবে প্রেমটা নেই। মানে বিয়েটা হয়ে গেছে আর কি। হ্যাঁ আমার প্রেমের ভীতটা অরকুটের ক্রিকেট কমিউনিটি। সবটাই আছে, শুধু অর্কুট থাকবে না এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমিই তো অর্কুট থেকে ফেসবুকে চলে গেছি। এমনকি আমার প্রোফাইলটাও ডিলিট করে দিয়েছিলাম অনেক আগেই। নিজেই দূর ছাই করেছি। তবু তো ছিল। চাইলেই তবু নাগাল পেতাম। পাত্তা না দিলেও পেতাম। আর অরকুট ডট কম এর সাইট-টা খুলবে না। প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেও না। তবু অর্কুট থাকবে। থাকতে হবে। প্রথম প্রেম কী কখনও ছেড়ে চলে যায়, না যেতে পারে? তাহলে অর্কুট-ই বা কী করে যাবে? আর অর্কুট তো সেই ভালবাসার মানুষটার মতো, যাকে যতই অবহেলা করি না কেন অস্বীকার করতে পারি না কিছুতেই। আর এতদিন তো জানতাম সেও কোনদিন ছেড়ে চলে যায় না। যেতে পারে না। তাহলে?

আজ
তাহলে ৩০শে সেপ্টেম্বর এসেই গেল। তার মানে এটাই শেষ। এক একবার মনে হচ্ছে সত্যিই কী আর কোন উপায় নেই? মানে কয়েকমাস আগে যেমন একটা মেল পেয়েছিলাম সেরকম আরেকটা যদি আসে? মানে হঠাৎ যদি সিদ্ধান্ত বদল করে গুগল। মানে নিদেনপক্ষে একটা বিবেচনা জাতীয় কিছু করবে টরবে বলে মেল পাঠায়? আর তারিখটা পিছিয়ে যায়...

আর তারপর আবার পিছিয়ে যায় আর এমনি করেই যদি তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ হতে থাকে... জাস্ট যদি...

Thursday 22 May 2014

সেই বাড়িটা

দরজা দিয়ে ঢুকে একটা সরু প্যাসেজ আর তারপরেই উঠোন।মনে হত যেন এক অন্য জগতে এসে পড়েছি। বাইরে দুপুরটা যতটা গনগন করছে, ভেতরটা ততটাই ঠান্ডা। বাইরে যাই হয়ে যাক না কেন, ভেতরের জগতটা কিচ্ছু জানে না। যত ব্যস্ততা সকাল এগারোটা পর্যন্ত, তারপর সন্ধ্যে পর্যন্ত একদম অন্য জগৎ। সকালে অবশ্য মনে হত যেন কোন কলতলায় এসে পড়েছি। উঠোন ভর্তি মহিলা, কাচ্চাবাচ্চা একসাথে কিচিরমিচির করছে। আমি একা নই, পাড়ায় সব্বাই বলত একই কথা- সকালে একবার কেউ বাড়িটায় এসে পড়লে ঘাবড়াতে বাধ্য। যদিও আমার সবথেকে বেশি ভাল লাগত ওই দুপুরবেলাটা- ওই ঠাণ্ডা বাড়িটা। এখন অবশ্য সারাক্ষণই নিঃস্তব্ধ থাকে বাড়িটা, আর আমাকে কুরে কুরে খায়। এখন মনে হয় আহারে, আমার বাড়িটা যদি সবসময়ে ওরকম থাকত, ওই সকালগুলোর মত সবসময়ে যদি গমগম করত বাড়িটা... বছরের পর বছর, জেনারেশনের পর জেনারেশন।
আমি কোনদিনই নিজের বাড়ি, জায়গা এইসব নিয়ে বিশাল আবেগপ্রবণ ছিলাম না। পুনেতে যখন গেলাম তখনও না, এখন এই ব্যাঙ্গালোরে এসেও সেভাবে কিছু মনে হয়নি। মানে, নিজের বাড়ি, শহর যে ঢের ভাল সেটা বোঝা মানেই কি নস্টালজিক হওয়া? তাহলে জানি না। কিন্তু আজকাল যে আমার কী হয়েছে...ছোটবেলাটা এইভাবে কখনো কষ্ট দেয়নি আগে। আমার একটা দারুণ ছোটবেলা ছিল যেটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে চলে গেছে, যেমন সবার যায়। এটুকুই। আসলে গত দুই-আড়াই বছরে ‘না-থাকা’ বা ‘হারিয়ে যাওয়া’ কী জিনিস সেটা আমি হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি। হয়তো তাই... হয়তো তাই আজকাল এত বেশি করে মনে পড়ছে আমার বাড়িটার কথা। ছোটবেলার মত ওটাও হারিয়ে যেতে পারে তো, তাই। বাড়িটার সাথে আমি যে এত ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, কখনও এভাবে মনে হয়নি। আজ যখন বাড়িটার নিজের অস্তিত্ব ফুরনোর মুখে, তখন বাড়িটা আরও বেশি করে চেপে ধরছে আমায়।
নাহ, ভূতের ভবিষ্যতের মতো ভবিষ্যৎ এখনও হয়নি। তবে ওই আর কি, ঘটতে বেশি দেরি নেই। আসলে বাড়িটা আমার দাদুর মা’র নামে যিনি এখন আর নেই। আমার দাদুরা পাঁচ ভাই। শরিকি বাড়ি। তবে দাদুদের মধ্যে কেউ, বা পরে তাঁদের ছেলেপুলেরা কেউ আর খাতায় কলমে মালিকানা বদলের কথা সিরিয়াসলি ভাবেননি। অতএব এখন আইনত বাড়িটার কোন মালিক নেই। আর মালিকানা দাবি করতে হলে এখন পুরো গুষ্টিকে একসাথে ধর্না দিতে হবে। আর আমাদের যা গুষ্টি, ফ্যামিলি-ট্রি’টা আমি একবারে নামাতে পারব বলে মনে হয় না!অতএব আমার সাধের বাড়িটা যে কোনদিন বেহাত হতেই পারে।
সেই বাড়িটা, যেটার দেওয়ালে মনের সুখে যা খুশি তাই এঁকে লিখে বেড়াতাম। সেই বাড়িটা, যেটাতে দুটো ইয়াব্বড়ো চৌবাচ্চা আছে। আর সেই চৌবাচ্চাগুলোতে দোলের দিন আমাদের রঙে চোবানো হত। সেই বাড়িটা, যেখানে কারোর শ্রাদ্ধ হলেও লোকে বিয়েবাড়ি বলে ভুল করত। নাহ, মোটেও আমরা সাজুগুজু করতাম না। আসলে আমাদের বংশে সবাই গলার আওয়াজের জন্য বিখ্যাত, তার ওপর বাড়িশুদ্ধু একগাদা লোক হলে যা হয় আর কী!
সেই বাড়িটা যেটা আমার বাড়ি। বাড়িটা কখনও আমাকে বুঝতেই দেয়নি যে আমি বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। বাবার দিক থেকে আমার নিজের বলতে শুধু আমার পিসতুতো দাদা। সেভাবে দেখলে আমার সমবয়সী কেউ ছিল না আমার নিজের ফ্যামিলিতে। তবু আমি কোনদিন একা ছিলাম না। বাবার তুতো ভাইদের কুচোকাচারা একা হতেই দেয়নি কখনও।
রোববার আমাদের সবার ঘরে মাংস হত আর আমরা খেলনাবাটি খেলতাম দোতলার বারান্দায়। তিন-চারদিন আগে থেকে সবাই মিলে টাইম ঠিক করে নেওয়া হত। ওইদিন আবার আমরা ইন্টারভাল দিয়ে দিয়ে খেলতাম- স্নান করা, খেতে বসা, পড়তে বসা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসল চাল-ডাল একটু-আধটু আলু পটল জোগাড় করে বসতাম আমরা। আমার একটা খেলনা ভর্তি ঝুড়ি আছে দাদুর ঘরে। কী নেই সেখানে! একটা খেলনাবাটির সংসারে যা যা থাকা সম্ভব, সব। দিদা আমার পুতুলের বালিশ-বিছানাও বানিয়ে দিত।দাদু বলেছিল ওই ঝুড়িটা আমার বিয়েতে যৌতুক দেবে। সেটা আবশ্য আর হয়ে ওঠেনি।
দরজা দিয়ে ঢুকেই যে প্যাসেজটা, ওখানে একদিকের দেওয়ালের গায়ে মিটারবক্স লাগানো। আমি আর আমার খুড়তুতো জেঠুর মেয়ে, দুজনে ওই মিটারবক্সের সামনের সরু জায়গাটা দিয়ে একসাথে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। সে কী কায়দা আমাদের! কোনরকমে যেতেই হবে! আসলে আমরা দুজনেই বেশ হৃষ্টপুষ্ট, তাই ওটাই একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের কাছে। বাড়িতে তিনটে ছাদ। তিনতলা, সাড়ে-তিনতলা আর চারতলা। আমাদের মোস্ট ফেভারিট ওই সাড়ে-তিনতলারটা। অবশ্য বিশ্বকর্মা পুজোর দিন দেখার মত হত চারতলার ছাদটা। আবার আবির খেলা বা বাজি পোড়ানোর জন্যে আদর্শ তিনতলার ছাদ। ওখানে দাদুদের টাকে আমরা আবির মাখাতাম।
আসলে প্রতিদিন যেন কোন না কোন অজুহাতে মেতে থাকত বাড়িটা। সেটা বেড়ালের বাচ্চা হলেও। অথচ সেই বাড়িটাই এখন সারাক্ষণ ঘুমোয়। এমনিতেই বাবার জেনারেশনে বাড়ির বেশিরভাগ ছেলেদেরই কন্যাসন্তান। অতএব বিয়ে টিয়ে করে একে একে তাদের বংশবিচ্ছেদ ঘটেছে। আমার মতই। আর বেশিরভাগই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। তাই আজকাল বাড়িটা আরও বেশি করে খাঁ খাঁ করে। তবে লোকজন এলেই বা কি, তাতে তো আর বাড়ির ভবিতব্য বদলাবে না। ও বাড়ি তো এমনিতেই অনাথ। মালিক-টালিক নেই, কবে হয়ত শুনব সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। মানে, বাড়িতে হাতে গোনা কজন থাকে ঠিকই, তবে ওই বাড়িটাই যে তাদের একমাত্র থাকার জায়গা এমনটাও নয়। তাই শুধু সময়ের অপেক্ষা আর কী!

আসলে বাড়িটা যেদিন আর থাকবে না, সেদিন আমার আর রুট বলে কিছু থাকবে না। তাই বোধহয় আজকাল এত খারাপ লাগে। বাংলাদেশ থেকে এসে আমার দাদুর বাবা কিনেছিলেন বাড়িটা। আমার বাড়ি বলতে আমি ওটাকেই চিনি। ওই বাড়িটার ঠাণ্ডা দেওয়ালগুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতাম। বড্ড আরাম হত।এখন বাড়িটাতে ঢুকলেই অদ্ভূত লাগে, অচেনা লাগে। ফ্ল্যাশব্যাকগুলো যে সত্যি, সেটা মনেই হয় না। গল্পে যা পড়েছি, সেই অনুভূতিগুলো যে এত তীব্র হতে পারে আগে কখনও মনে হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার তবু একটা আলাদা জগৎ আছে, বাড়িটার তো কিছু নেই। সদস্য এতটাই গোনাগুনতি, বাড়িটা এমনিতেই শ্মশান মনে হয়। একদিন একটা ইঁটও থাকবে না আর। আর সেই অঘটনটা হয়তো আমার জীবদ্দশাতেই ঘটবে। তার সাথে আমার অস্তিত্বটাও হারিয়ে যাবে, চোখের সামনে। আমার জাস্ট কিচ্ছু করার নেই, অথবা আমি ব্যর্থ।