গল্পটি বর্ণদূত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
বর্ণদূত পত্রিকা- দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা।তারিখ - ১২ই আষাঢ় ১৪২৩।
_____________________________________________________________________________
কলকাতা শহর, ২০১২
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ঘড়িতে তাকিয়ে মাম দেখল সাড়ে চারটে। উঠে জল খেল। মাকে ডাকবে ভেবেও ডাকল না। আসলে গত আট মাস হল, এটা এখন রোজকার ব্যাপার হয়ে গেছে। সেই এক
স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যাবে। চোখের কোণ ভেজা। জল খাবে আর শুয়ে ভাববে, কী দেখল এটা। রোজ যে
হুবহু একই স্বপ্ন তা কিন্তু নয়। আসলে ধরণটা একদম এক। রোজই স্বপ্নে বাবাকে দেখে।
বাবার সাথে কোনও কথা হয় না। শুধু বাবাকে দেখতে পায় এক ঝলক তারপর বাবা
কোথাও একটা চলে যায়। বাবা কখন আসবে আবার এই ভেবে মাম কাঁদতে থাকে। কোনওদিন আবার বাবাকে দেখতেও
পায় না। বাবা আছে, কোথাও গেছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে বাবা আসছে না। আর মাম
হাপুসনয়নে ‘বাবা বাবা’ করে ডাকছে আর কান্নাকাটি করছে।
ব্যাস, এটুকুই। ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়ার পর যে কী অসহায়
লাগে! বাবা নেই, আট মাসেও এটা মেয়েটা মেনে নিতে পারল না। ঘুম ভেঙে এদিক ওদিক
কিছুক্ষণ দেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।
_____________________________________________________________________________
তাকালক শহর, ২০২০
আবার। আবার সেই এক স্বপ্ন। একরত্তি দুষ্টু
বুঝে উঠতে পারে না কী করবে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যতগুলো রাত কাটিয়েছে, রোজ ঘুম ভেঙেছে মাঝরাতে। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে
থেকেছে বাবা-মার মুখের দিকে। তারপর আবার শুয়ে পড়েছে। বড়রা
বিশেষ পাত্তা দেয়নি। ছোটরা তো ওরম কত স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সাত বছরের শিশুমন বুঝতে পারে এ কোন সাধারণ ভূত-পেত্নীর স্বপ্ন নয়। তাই তো সে ভয়ও পায় না একদম।
দুষ্টু দেখতে পায় একটা বাড়ি। তার নিজের বাড়ি। কেমন পুরোনো দেখতে লাগে বাড়িটা স্বপ্নে। আর কয়েকটা মুখ। বিশেষ করে
দুজন মহিলা, একটা ছেলে, আর একটা মেয়ে। কারোর মুখে হাসি নেই। ছেলেটা তবু মাঝেমধ্যে হেসে ওঠে। মহিলা দুজনকে দেখে কষ্ট হয়। একজনের চোখ তো
সারাক্ষণ ছলছল করে। সবথেকে অদ্ভুত মেয়েটা। খালি কাঁদে আর বাবা বাবা করে ডেকে ওঠে।
কত করে ডাকে, ওর বাবা কোথায় কে জানে। একদিনও মেয়েটার বাবাকে দেখতে পায় না কিন্তু
দুষ্টু একদিন মেয়েটাকে দেখল একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ‘বাবা বাবা’ বলে খুব কাঁদছে। একটা অনেক বড় লোকের ছবি।
দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চশমা। দুষ্টুর লোকটাকে দেখে বেশ রাগী মনে হল। মেয়েটা এই লোকটার
সামনে কাঁদছে কেন? তাহলে কী এটাই ওর বাবা? কোথায় চলে গেছে বাজে লোকটা? দুষ্টুর খুব
রাগ হয়।
আরেকদিন ওই ঘরটাতেই
ওই রাগী লোকটার ছবির পাশে দুটো ছবি দেখতে পেয়ে ঘুম ভেঙে গেছিল দুষ্টুর। সেদিন বেশ ভয় পেয়েছিল সে। পরদিন ঘুমের
জন্যে অপেক্ষা করছিল। যেটা দেখেছিল আগের রাতে সেটা ঠিক তো? নাহ। কোন ভুল নেই। ওই ছবি দুটো দুষ্টুর
বাবা-মার। একটু বুড়ো-বুড়ো লাগছে দুজনকেই। বাবাকে তো বেশ বুড়ো লাগল দুষ্টুর।
কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কী এসব। তার নিজের বাড়িতে এরা কারা? আবার একদিন যেন
দাদু-ঠাম্মার ছবি দেখতে পায় দুষ্টু। আর ভয় পায় না।
শুধু অবাক হয়। বড়দের দু একবার বলতে গিয়ে লাভ হয়নি। এরা কারা দুষ্টু জানে না। কোনওদিন জানতে পারবে কিনা তাও জানে না।
শুধু জানে এদের দেখার জন্যে সে অপেক্ষা করে। খালি ঘুমোতে চায়। ওই মুখগুলো তাকে
বড্ড টানে। আর ওই লোকটার ওপর খুব রাগ হয়। ‘বাবা বাবা’ কত করে ডাকে মেয়েটা, লোকটা কোথায়?
_____________________________________________________________________________
কলকাতা ২০২০
স্বপ্নটার শেষ কোথায় মাম জানে না। কত মানুষের
সাথেই তো এমন ঘটনা ঘটে। সবার সাথে কি এরকম হয়? তার
আশেপাশে কাউকে তো এরকম কিছু বলতে শোনেনি। নাকি হয় সবার সাথেই, কেউ বলে না?
প্রথম প্রথম মামের মনে হত সদ্য বাবা হারানোর
কষ্টটা মানতে পারছে না তাই এসব স্বপ্ন। যদিও এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন কেন, যা দেখে মনে হয় বাবা আসবে, আজ না হোক কাল নিশ্চয়ই দেখা হবে? বুঝতে পারত না। সবাই
তো বলে আমরা সারাদিন যা ভাবি, যা চাই তাই স্বপ্নে দেখতে পাই। মাম বাবাকে চায়, ঠিক।
বাবার কথা ভাবে, ঠিক। কিন্তু বাবা কোথাও গেছে, বাবার জন্যে সে অপেক্ষা করছে, এরকম তো কখনো হয়নি। এসব সে ভাবেও না। সে ভাবে বাবা থাকলে কী হতে পারত, কত
অন্যরকম হত সব। অথচ এইসব ভাবনারা স্বপ্নে আসে না কখনো।
আজ আট বছর হয়ে গেল। এই স্বপ্ন দেখার কিন্তু কোন বিরাম নেই। এখন মাম নিশ্চিত, বাবার সাথে তার দেখা হবেই। স্বপ্নের অন্যদিকে হয়তো কোন অন্য জগৎ আছে, যার খোঁজ আমরা কেউ পাইনি। হয়তো মৃত্যুর পর মানুষের নতুন জন্ম হয় সেই অন্য পৃথিবী তে। সেখানে গেলে শুধু বাবা কেন, দাদু-ঠাম্মাকেও পাবে হয়তো মাম। দাদুকে সে খুব মিস করে। কান্না পায় খুব ক্রিকেট দেখতে বসলে। এখন অবশ্য মামের মজা হয়, কারণ সে জানে এই স্বপ্নের মানে। সে জানে কোনও না কোনওদিন দাদু, বাবার সাথে তার ঠিক দেখা হবে। তার বিশ্বাস বাবা আর দাদু আছে। অন্য কোন জগতে। আমাদের মত করেই আছে। বাবার সাথে তার অনেক কথা আছে। চিন্তা একটাই, বাবা চিনতে পারবে তো?