Thursday, 23 October 2014

একটা চিঠি

লেখাটা সেই ২০১২-তে লেখা... একটা ম্যাগাজিনের জন্যে লিখেছিলাম। মনে হল পোস্ট করি। কিছু কিছু এডিট করে পোস্টটা করে ফেললাম। 


শ্রদ্ধাস্পদেষু,

নবমীর দিন সকালে একটা ফোন পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেই ফোনটাতেই জানতে পারি যে আপনি আর নেই। সত্যি বলতে কী ঘুমের রেশটা তখনো কাটেনি বলেই বোধহয় প্রথমে কিছুই মনে হয়নি। শুধু একটা খবর। খারাপ খবর। তারপরে মাকে খবরটা জানাই। মায়ের প্রথম কথাই ছিল যাঃ। নাহ্‌ তখনও আমি সেইভাবে কিছু অনুভব করিনি। টিভিটা চালালাম। যা হয়। কেউ চলে গেলে তাকে নিয়ে মাতামাতি হওয়াটা ব্যতিক্রমী কিছু নয়। কিন্তু চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে একটা খবরে চোখ আতকে গেল- ‘নবমীতে নেই নীললোহিত’। এই ‘নেই’ ব্যাপারটা শুনেই কেমন একটা খালি খালি লাগছিল। ঠিক কেন বুঝিনি। আমি তো বিশাল সাহিত্যবোদ্ধা নই যে ‘নীরা’র জন্য মন খারাপ হবে কিম্বা আপনার অন্য কবিতাগুলোর কথা মনে পড়বে। তবুও কীসের যেন একটা অভাববোধ করছিলাম। হাল্কা একটা খারাপ লাগা- কিন্তু ঠিক কী? কেন? মনখারাপটা নিয়েই নেট খুলে বসলাম। ফেসবুকে দু-একটা পোস্ট চোখে পড়ল আর চোখে পড়ল একটা ব্লগ। তপোব্রত’র লেখা। লেখাটা আপনাকে নিয়েই। আপনি কত ভাল, বাংলা সাহিত্যের কত বড় নক্ষত্র- এসব আর কী! বোঝেনই তো! পড়লাম। লেখার শেষ লাইনটা পড়েই খুব মন খারাপ হয়ে গেল।খুব! হঠাৎ মনে হল, কী বিশাল এক সম্পদ হারিয়ে ফেললাম আমি। লেখার শেষ লাইনটা ছিল, “কাকাবাবুর ক্রাচের শব্দ আর শুনতে পাব না” হ্যাঁ, নীরা নয়, নীল মানুষ নয়, গঙ্গানারায়ণ নয়- কেউ নয়। কাকাবাবু। আমি কাকাবাবুকে হারালাম। ‘কাকাবাবু’ আর নেই। এটা যেই বুঝলাম, খারাপ লাগাটা আরও বেশি করে চেপে বসল। কাকাবাবু নেই মানে যে আমার শৈশবের অনেকটাই আর নেই।

ঠিক মনে নেই কবে থেকে, যেদিন থেকে গল্পের বই পড়া শুরু তখন থেকেই কাকাবাবুর পাগল ভক্ত আমি। শুনলে হয়তো অনেকে হাসবেন, আপনিও হয়তো। ফেলুদা নয়, কাকাবাবু দিয়েই আমার গোয়েন্দা গল্প পড়া শুরু। তারপরেই একে একে ফেলুদা, শার্লক হোমস, ব্যোমকেশের আগমন। আপনি হয়তো ভাবছেন আজ আপনি নেই বলে এসব বলছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন এটাই সত্যি।

আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী তো ছিলই, আমার মনে আছে যখন ‘কাকাবাবু সমগ্র’ বেরোতে শুরু হল, মা আমাকে প্রতি জন্মদিনে একটা করে কাকাবাবু সমগ্র কিনে দিত। কী খুশিই না হতাম। ‘কাকাবাবু সমগ্র ৬’ অবশ্য এখনো পড়া হয়নি। এই অগস্টেই কিনেছি। কাকাবাবু আমার শৈশবের ঠিক কতটা জুড়ে ছিল আমি নিজেও জানি না। মনে পড়ে একটা স্বপ্নও দেখেছিলাম। আমার কিছু স্কুলের বন্ধু, আমি, কাকাবাবু আর সন্তু একটা ভাঙ্গা সিঁড়ি দিয়ে নামছি। হাতে মোমবাতি। খুব হাসি পেয়েছিল পরে। আর একবার বইমেলায় আপনাকে দেখেছিলাম। ছোটবেলায় তো, তাই খুব ভাল করে মনে নেই। স্টেজে ছিলেন আপনি। তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, আর আমি বাবা-মার সঙ্গে সেই বিকেল থেকে ঘুরছি। তখন বেরোব বেরোব করছি আর আপনাকে দেখতে পেলাম। ব্যাস, আমাকে আর পায় কে! কথা বলব, কথা বলব করে বায়না জুড়লাম। কোনও একটা অনুষ্ঠান চলছিল বলেই বাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে তখনই কথা বলা সম্ভব নয়। অপেক্ষা করা মানে আরো দেরী হওয়া। তাই আর কী, ধমক দিয়ে দমিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন, বাবার ওপর খুব রাগ হয়েছিল। এখন বড্ড বেশি মনে পড়ছে সেই সন্ধ্যেটা আর খুব কান্না পাচ্ছে। নাহ, আজ আর রাগ নেই, মানে কী লাভ? যাই হোক। সেদিন আমার প্রশ্নটা কী ছিল জানেন? ‘কাকাবাবু’ আবার কবে বেরোবে? হ্যাঁ আমার কাছে সুনীল গাঙ্গুলি মানেই কাকাবাবু। বড় হয়ে আপনার আরও অনেক লেখা পড়েছি। মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু আপ্লুত হইনি। কোন চরিত্রের ফ্যান হয়ে যাইনি। কাকাবাবুর জন্য আমি এতটাই পাগল ছিলাম।

কাকাবাবুকে কেন ভাল লাগত জানি না। আমাকে অনেকে এই প্রশ্ন করেছে। আমি উত্তর দিতে পারিনি। আমার তো কাকাবাবুকে এমনি এমনিই ভাল লাগে। ‘হিরোইজম’-এর কিছুই সেভাবে আমার কাকাবাবুর মধ্যে নেই। একটা পা অকেজো, ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন। পঞ্চাশোর্ধ বয়স এখন। বিরাট কিছু হ্যান্ডসাম, তাও নন। তবু ওনাকেই আমার ভাল লাগে। ভাবতে অবাক লাগে যে বন্দুক থাকলেও কাকাবাবু খুব একটা গুলি চালান না। পারেন না আর কী! কাউকে অত্যাচার করতে পছন্দ করেন না। তবে হ্যাঁ, কেউ ওনাকে অকারণে কষ্ট দিলে সেটা ফেরত দিতে ভোলেন না। মনে আছে ‘নীলমূর্তি রহস্য’তে ভিলেন, যিনি আবার জোজোর পিসেমশাই, তাঁর গায়ে লাল  পিঁপড়ে ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুতভাবে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। এদিকে ভাইপো সন্তুর ব্যাপারে প্রচন্ড যত্নবান, আবেগপ্রবণ। সন্তুর কোনরকম বিপদে কাকাবাবু মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। এখানেই তিনি অন্য সব গোয়েন্দার থেকে আলাদা। এজন্যেই তিনি ‘কাকাবাবু’, খুব সহজেই শুধু সন্তু নয়, সবার কাকাবাবু হয়ে উঠতে পারেন।

সন্তুর কথা যখন এসেই গেল তখন একটা সিক্রেট আজ বলেই ফেলি। আমার ছোট্টবেলার প্রথম ক্রাশ সন্তু। জোজো আবার ঠিক উল্টো, চরম ভীতু, এদিকে মনের সুখে গুল মারে। কাকাবাবু মিথ্যে ঘৃণা করলেও জোজোকে বেশ পছন্দ করেন দেখেছি। জোজোর ঐ গুলবাজি আমারও দারুণ লাগে। ট্যালেন্ট আছে ছেলের। তবে ঐ মেয়েটা- দেবলীনা দত্ত। ওকে কিন্তু আমার বেশ হিংসে হত। শেষ কয়েকটা রহস্য উপন্যাসে দেবলীনা নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। কী যে ইচ্ছে হত দেবলীনা হতে। আর ভাল লাগতো নরেন্দ্র ভার্মাকে।

জানেন, আমার বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে আপনাকে কাকাবাবু নিয়ে অনেক অনেক প্রশ্ন করব। কী প্রশ্ন জানি না, শুধু জানতাম ‘কাকাবাবু’ কে নিয়ে কথা বলব। আমার কাছে যে আপনিই কাকাবাবু! আপনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। আপনার হয়তো মনে নেই, আমার আছে। প্রতিবারই শুনেছি, “হ্যাঁ বলো, কী জানতে চাও?” অনেক কিছু জেনেছি। কোনদিন ফিরিয়ে দেননি। কিন্তু কাকাবাবুকে নিয়ে কথা তুলতেই পারিনি।সত্যি বলছি ভাবতেই পারিনি এরকম হঠাৎ করেই চলে যাবেন, একেবারে জানান না দিয়ে! আমি যে ঠিক কী হারালাম বোঝাতে পারব না। আপনি আমাকে কী দিয়ে গেছেন, আমার ছোটবেলাকে কী দিয়ে গেছেন, আমার ছোটবেলাকে কিভাবে ভরিয়ে দিয়েছেন আপনি নিজেও বোধ হয় জানেন না। আমি নিশ্চিত আমি একা নই, ‘কাকাবাবু’র এরকম অসংখ্য পাগল ভাইপো-ভাইঝি আছে। কেউ সন্তুর মতো, কেউ জোজোর মতো, কেউ দেবলীনার মতো, কেউ আবার এই শ্রেয়সীর মত।
ছোটবেলায় কতবার ভেবেছি চিঠি লিখব, হয়ে ওঠেনি। সাহসও হয়নি আসলে। মানে মনে হয়েছে যদি উত্তর না পাই। আর আজ দেখুন, উত্তর পাব না জেনেও লিখছি। লিখতে হচ্ছে। নাহলে আরও কষ্ট হবে যে। 
সেদিনই ‘গোলকধাঁধায় কাকাবাবু’টা পড়ছিলাম। এবারের আনন্দমেলায় কাকাবাবু নিয়ে বেরনো আপনার শেষ লেখা। ভাল লাগেনি। সত্যি বলছি। শুধু এটাই না, শেষ পাঁচ-ছটা কাকাবাবু আমার একদমই ভাল লাগেনি। কাকাবাবুর পাগল ভক্ত হয়েও লাগেনি। বন্ধুদের মধ্যে আলোচনাও করেছি, কেন যে সুনীল গাঙ্গুলি লিখছেন এরকম। লেখার থেকে না লেখাই ভাল তো। হ্যাঁ এরকম কত কথাই তো বলেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভাগ্যিস লিখেছিলেন। ‘কাকাবাবু’কে থামতে দেননি। ‘কাকাবাবু’ আজও অমর।
কদিন আগে একটা লেখায় চোখ পড়েছিল। ফেসবুকে একজন লিখেছে ১৯৯৮-এর পর সে আর আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী কেনেনি। কেন জানেন? ৯৮’র ‘কাকাবাবু’টা শেষ করতে পারেনি। একদম ভাল লাগেনি। ব্যাস আনন্দমেলা পড়াই শেষ! ভাবুন তাহলে কী করেছেন আপনি! এটাই কাকাবাবুর ম্যাজিক, আপনার ম্যাজিক! আমিও অবশ্য সামনের বছর থেকে আনন্দমেলা আর কিনব না। কারণটা আর নিশ্চয়ই বলতে হবে না...
আপনি আজ নেই। তবে লোকে বলে আত্মা অবিনশ্বর। আপনার মত নাস্তিক লোক আত্মা-টাত্মা মানতেন বলে মনে হয় না। আমিও মানি না খুব একটা। কিন্তু কেন জানি না, মনে হয় এখনো হয়তো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মধ্যরাতে কলকাতা দাপিয়ে বেড়ানোর প্ল্যান করছেন। আপনার জীব্বদশায় কাকাবাবু নিয়ে কথা বলা হয়নি। এটা আমার জীবনের বড় আফশোষ। তখন পারিনি, আজ বলছি, থ্যাঙ্ক ইউ। আমাকে এরকম দারুণ একটা শৈশব দেওয়ার জন্য। ‘কাকাবাবু’কে থামতে না দেওয়ার জন্য, অবিরাম লিখে যাওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
তবে ওই ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’ নামটাতে আমার বড্ড আপত্তি। এরকম একটা নাম না দিলেই পারতেন। কারণ, কাকাবাবু তো হারতে পারেন না। রাজা রায়চৌধুরী কোনদিন হারেন না।
২০১২ আমার থেকে অনেককিছু কেড়ে নিয়েছে। আমি আর কোনদিন ‘আমি’ হয়ে উঠতে পারব না। ডিটেলে নাই বা গেলাম, এটুকু বলতে পারি তার জন্যে কিছুটা আপনিও দায়ী। মানে... মানে সামনের পুজোতে সব থাকবে শুধু আমার কাকাবাবু থাকবে না। আমার পুজো বলতে তো ওইটুকুই ছিল আর, সেটাও থাকবে না...এটা কি মেনে নেওয়া যায় বলুন?
ইতি
‘কাকাবাবু’র জনৈকা ভাইঝি