Thursday, 22 May 2014

সেই বাড়িটা

দরজা দিয়ে ঢুকে একটা সরু প্যাসেজ আর তারপরেই উঠোন।মনে হত যেন এক অন্য জগতে এসে পড়েছি। বাইরে দুপুরটা যতটা গনগন করছে, ভেতরটা ততটাই ঠান্ডা। বাইরে যাই হয়ে যাক না কেন, ভেতরের জগতটা কিচ্ছু জানে না। যত ব্যস্ততা সকাল এগারোটা পর্যন্ত, তারপর সন্ধ্যে পর্যন্ত একদম অন্য জগৎ। সকালে অবশ্য মনে হত যেন কোন কলতলায় এসে পড়েছি। উঠোন ভর্তি মহিলা, কাচ্চাবাচ্চা একসাথে কিচিরমিচির করছে। আমি একা নই, পাড়ায় সব্বাই বলত একই কথা- সকালে একবার কেউ বাড়িটায় এসে পড়লে ঘাবড়াতে বাধ্য। যদিও আমার সবথেকে বেশি ভাল লাগত ওই দুপুরবেলাটা- ওই ঠাণ্ডা বাড়িটা। এখন অবশ্য সারাক্ষণই নিঃস্তব্ধ থাকে বাড়িটা, আর আমাকে কুরে কুরে খায়। এখন মনে হয় আহারে, আমার বাড়িটা যদি সবসময়ে ওরকম থাকত, ওই সকালগুলোর মত সবসময়ে যদি গমগম করত বাড়িটা... বছরের পর বছর, জেনারেশনের পর জেনারেশন।
আমি কোনদিনই নিজের বাড়ি, জায়গা এইসব নিয়ে বিশাল আবেগপ্রবণ ছিলাম না। পুনেতে যখন গেলাম তখনও না, এখন এই ব্যাঙ্গালোরে এসেও সেভাবে কিছু মনে হয়নি। মানে, নিজের বাড়ি, শহর যে ঢের ভাল সেটা বোঝা মানেই কি নস্টালজিক হওয়া? তাহলে জানি না। কিন্তু আজকাল যে আমার কী হয়েছে...ছোটবেলাটা এইভাবে কখনো কষ্ট দেয়নি আগে। আমার একটা দারুণ ছোটবেলা ছিল যেটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে চলে গেছে, যেমন সবার যায়। এটুকুই। আসলে গত দুই-আড়াই বছরে ‘না-থাকা’ বা ‘হারিয়ে যাওয়া’ কী জিনিস সেটা আমি হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি। হয়তো তাই... হয়তো তাই আজকাল এত বেশি করে মনে পড়ছে আমার বাড়িটার কথা। ছোটবেলার মত ওটাও হারিয়ে যেতে পারে তো, তাই। বাড়িটার সাথে আমি যে এত ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, কখনও এভাবে মনে হয়নি। আজ যখন বাড়িটার নিজের অস্তিত্ব ফুরনোর মুখে, তখন বাড়িটা আরও বেশি করে চেপে ধরছে আমায়।
নাহ, ভূতের ভবিষ্যতের মতো ভবিষ্যৎ এখনও হয়নি। তবে ওই আর কি, ঘটতে বেশি দেরি নেই। আসলে বাড়িটা আমার দাদুর মা’র নামে যিনি এখন আর নেই। আমার দাদুরা পাঁচ ভাই। শরিকি বাড়ি। তবে দাদুদের মধ্যে কেউ, বা পরে তাঁদের ছেলেপুলেরা কেউ আর খাতায় কলমে মালিকানা বদলের কথা সিরিয়াসলি ভাবেননি। অতএব এখন আইনত বাড়িটার কোন মালিক নেই। আর মালিকানা দাবি করতে হলে এখন পুরো গুষ্টিকে একসাথে ধর্না দিতে হবে। আর আমাদের যা গুষ্টি, ফ্যামিলি-ট্রি’টা আমি একবারে নামাতে পারব বলে মনে হয় না!অতএব আমার সাধের বাড়িটা যে কোনদিন বেহাত হতেই পারে।
সেই বাড়িটা, যেটার দেওয়ালে মনের সুখে যা খুশি তাই এঁকে লিখে বেড়াতাম। সেই বাড়িটা, যেটাতে দুটো ইয়াব্বড়ো চৌবাচ্চা আছে। আর সেই চৌবাচ্চাগুলোতে দোলের দিন আমাদের রঙে চোবানো হত। সেই বাড়িটা, যেখানে কারোর শ্রাদ্ধ হলেও লোকে বিয়েবাড়ি বলে ভুল করত। নাহ, মোটেও আমরা সাজুগুজু করতাম না। আসলে আমাদের বংশে সবাই গলার আওয়াজের জন্য বিখ্যাত, তার ওপর বাড়িশুদ্ধু একগাদা লোক হলে যা হয় আর কী!
সেই বাড়িটা যেটা আমার বাড়ি। বাড়িটা কখনও আমাকে বুঝতেই দেয়নি যে আমি বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। বাবার দিক থেকে আমার নিজের বলতে শুধু আমার পিসতুতো দাদা। সেভাবে দেখলে আমার সমবয়সী কেউ ছিল না আমার নিজের ফ্যামিলিতে। তবু আমি কোনদিন একা ছিলাম না। বাবার তুতো ভাইদের কুচোকাচারা একা হতেই দেয়নি কখনও।
রোববার আমাদের সবার ঘরে মাংস হত আর আমরা খেলনাবাটি খেলতাম দোতলার বারান্দায়। তিন-চারদিন আগে থেকে সবাই মিলে টাইম ঠিক করে নেওয়া হত। ওইদিন আবার আমরা ইন্টারভাল দিয়ে দিয়ে খেলতাম- স্নান করা, খেতে বসা, পড়তে বসা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসল চাল-ডাল একটু-আধটু আলু পটল জোগাড় করে বসতাম আমরা। আমার একটা খেলনা ভর্তি ঝুড়ি আছে দাদুর ঘরে। কী নেই সেখানে! একটা খেলনাবাটির সংসারে যা যা থাকা সম্ভব, সব। দিদা আমার পুতুলের বালিশ-বিছানাও বানিয়ে দিত।দাদু বলেছিল ওই ঝুড়িটা আমার বিয়েতে যৌতুক দেবে। সেটা আবশ্য আর হয়ে ওঠেনি।
দরজা দিয়ে ঢুকেই যে প্যাসেজটা, ওখানে একদিকের দেওয়ালের গায়ে মিটারবক্স লাগানো। আমি আর আমার খুড়তুতো জেঠুর মেয়ে, দুজনে ওই মিটারবক্সের সামনের সরু জায়গাটা দিয়ে একসাথে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। সে কী কায়দা আমাদের! কোনরকমে যেতেই হবে! আসলে আমরা দুজনেই বেশ হৃষ্টপুষ্ট, তাই ওটাই একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের কাছে। বাড়িতে তিনটে ছাদ। তিনতলা, সাড়ে-তিনতলা আর চারতলা। আমাদের মোস্ট ফেভারিট ওই সাড়ে-তিনতলারটা। অবশ্য বিশ্বকর্মা পুজোর দিন দেখার মত হত চারতলার ছাদটা। আবার আবির খেলা বা বাজি পোড়ানোর জন্যে আদর্শ তিনতলার ছাদ। ওখানে দাদুদের টাকে আমরা আবির মাখাতাম।
আসলে প্রতিদিন যেন কোন না কোন অজুহাতে মেতে থাকত বাড়িটা। সেটা বেড়ালের বাচ্চা হলেও। অথচ সেই বাড়িটাই এখন সারাক্ষণ ঘুমোয়। এমনিতেই বাবার জেনারেশনে বাড়ির বেশিরভাগ ছেলেদেরই কন্যাসন্তান। অতএব বিয়ে টিয়ে করে একে একে তাদের বংশবিচ্ছেদ ঘটেছে। আমার মতই। আর বেশিরভাগই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। তাই আজকাল বাড়িটা আরও বেশি করে খাঁ খাঁ করে। তবে লোকজন এলেই বা কি, তাতে তো আর বাড়ির ভবিতব্য বদলাবে না। ও বাড়ি তো এমনিতেই অনাথ। মালিক-টালিক নেই, কবে হয়ত শুনব সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। মানে, বাড়িতে হাতে গোনা কজন থাকে ঠিকই, তবে ওই বাড়িটাই যে তাদের একমাত্র থাকার জায়গা এমনটাও নয়। তাই শুধু সময়ের অপেক্ষা আর কী!

আসলে বাড়িটা যেদিন আর থাকবে না, সেদিন আমার আর রুট বলে কিছু থাকবে না। তাই বোধহয় আজকাল এত খারাপ লাগে। বাংলাদেশ থেকে এসে আমার দাদুর বাবা কিনেছিলেন বাড়িটা। আমার বাড়ি বলতে আমি ওটাকেই চিনি। ওই বাড়িটার ঠাণ্ডা দেওয়ালগুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতাম। বড্ড আরাম হত।এখন বাড়িটাতে ঢুকলেই অদ্ভূত লাগে, অচেনা লাগে। ফ্ল্যাশব্যাকগুলো যে সত্যি, সেটা মনেই হয় না। গল্পে যা পড়েছি, সেই অনুভূতিগুলো যে এত তীব্র হতে পারে আগে কখনও মনে হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার তবু একটা আলাদা জগৎ আছে, বাড়িটার তো কিছু নেই। সদস্য এতটাই গোনাগুনতি, বাড়িটা এমনিতেই শ্মশান মনে হয়। একদিন একটা ইঁটও থাকবে না আর। আর সেই অঘটনটা হয়তো আমার জীবদ্দশাতেই ঘটবে। তার সাথে আমার অস্তিত্বটাও হারিয়ে যাবে, চোখের সামনে। আমার জাস্ট কিচ্ছু করার নেই, অথবা আমি ব্যর্থ।